বাংলাদেশের সামাজিক ও প্রগতিশীল মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে থাকা সংগঠনগুলোর মধ্যে হেফাজতে ইসলাম অন্যতম। এই সংগঠনটি মূলত ইসলাম ধর্মের রক্ষাকারী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করলেও, তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া, কার্যক্রম এবং মতাদর্শ সমাজের অগ্রগতির পথে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষ করে নারীদের অধিকার, সমানাধিকার এবং সমাজের স্বাধীন চিন্তাচেতনার ওপর তাদের যে নেতিবাচক প্রভাব, তা উদ্বেগের বিষয়।
হেফাজতে ইসলাম নারীদের জন্য যে ভূমিকাটি নির্ধারণ করতে চায়, তা স্পষ্টভাবে পিছিয়ে পড়া মনোভাবেরই প্রতিফলন। তারা মনে করে, নারীদের জন্য স্বাধীনতা কিংবা সমানাধিকারের সুযোগ থাকা উচিত নয়; বরং তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ঘরকেন্দ্রিক, পুরুষের আনুগত্যে আবদ্ধ একটি সীমিত জীবন যাপন করা। এটি একটি চিন্তাশীল ও স্বাধীন সমাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বর্তমান বিশ্বের নারীবাদী আন্দোলনগুলোর বিপরীতে অবস্থান করছে। যখন নারীর অধিকারকে খর্ব করা হয় এবং তাদের সমাজে সমান মর্যাদা প্রদানের কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হয়, তখন এটি একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য বাধা হিসেবে দেখা দেয়। নারীরা আজ শুধুমাত্র পরিবারের সদস্য নয়, বরং কর্মজীবন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অথচ হেফাজতের মতো সংগঠনগুলো এই অর্জনগুলোকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
নারী অধিকার নিয়ে হেফাজতে ইসলামের এই চিন্তাভাবনা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। একজন শিশু যখন নারীর অধিকারকে খর্ব করার কথা শুনে বড় হয়, তখন সে সমাজে সেই ভুল ধারণাকে গ্রহণ করতে শেখে এবং সমাজে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে সংকীর্ণ মনোভাব পোষণ করে। এটি ভবিষ্যতে সমাজে আরও বেশি বৈষম্য সৃষ্টি করবে এবং সমানাধিকারের ধারণাকে বিপর্যস্ত করবে।
এছাড়া, হেফাজতে ইসলামের কিছু বক্তব্য এবং কার্যক্রমে জঙ্গিবাদী মনোভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের বিভিন্ন সমাবেশে সহিংস বক্তৃতা, হুমকি প্রদান এবং উগ্র মতবাদ ছড়ানোর চেষ্টা সমাজে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। যখন একটি সংগঠন তার মতামত প্রচারের জন্য সহিংসতার আশ্রয় নেয়, তখন এটি মৌলবাদী চিন্তার উত্থানকেই নির্দেশ করে। এই ধরণের কার্যক্রম শুধু দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যই হুমকি নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, সামাজিক সংহতি, এবং সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক বিপদ।
হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব মতবাদ প্রচারের জন্য ইসলামের অপব্যাখ্যা ব্যবহার করে সমাজে ভয় এবং বিভাজনের বীজ বপন করে। তারা দাবি করে যে, তাদের কার্যক্রম ইসলামকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের চরমপন্থা সমাজের ঐক্য, সংহতি এবং শান্তি বিনষ্ট করার অন্যতম কারণ। ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান করা একটি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি তখনই প্রযোজ্য যখন সেই মূল্যবোধগুলো সহনশীলতা, মানবতা এবং সাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে, বিশেষত নারীদের অধিকার খর্ব করার জন্য যদি ইসলামের নাম ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেটি একটি চরমপন্থী অবস্থান হয়ে দাঁড়ায়।
যদি আমরা একটি প্রগতিশীল, সমতাভিত্তিক এবং নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তাহলে এই ধরনের চরমপন্থী কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে এবং নারী অধিকার, সমানাধিকার, ও স্বাধীন চিন্তার প্রসারে কাজ করতে হবে। নারীরা সমাজের সমান অংশীদার এবং তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ কল্পনা করা সম্ভব নয়।
হেফাজতে ইসলামের চরমপন্থী চিন্তাধারাকে প্রতিহত করে আমাদের অবশ্যই নারীদের জন্য একটি নিরাপদ, স্বাধীন এবং সমানাধিকারের সমাজ গঠনে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এসব চরমপন্থী কার্যক্রম যদি বন্ধ না করা হয়, তাহলে আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং সমাজে বৈষম্য ও সহিংসতার মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।