প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু, চট্টগ্রামের কর্নফুলী নদীর নীচে ইংলিশ চ্যানেলের আদলে টানেল সড়ক, মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট, যানজট জর্জরিত ঢাকায় বৈদ্যুতিক মেট্রো ট্রেন, নাকি নির্মানের প্রায় শেষ পর্যায়ে থাকা বাংলাদেশের প্রথম পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র?
এসব প্রকল্পের কোনটিকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নের সেরা উদাহরণ বলা যায়?
ঢাকার শেরে বাংলা নগরে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের চারপাশে একটা চক্কর দিলেই দেখতে পাবেন এর দেয়ালে থরে থরে শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের এমন নানা উন্নয়নের সচিত্র বিজ্ঞাপন।
দেশের সর্বত্রই এমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের তিন মেয়াদের অর্জন হিসেবে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের যথেষ্ট প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের একটি ঐতিহ্যবাহী খবরের কাগজ দ্য স্টেটসম্যান ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখে, স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরনির্ভরতার জন্য যে বাংলাদেশ ‘বাস্কেট কেস’ বলে বিবেচিত হত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেটি এখন নজিরবিহীন উন্নয়ন দেখছে।
এই বক্তব্যের সাথে একমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক নাজনীন সুলতানা।
“এটা স্বীকার না করার কোন উপায় নেই বাংলাদেশে যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে গত পনেরো বছরে সেটা আসলে তার আগের বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী যে পঁয়ত্রিশ বছরের উন্নয়ন তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি”, বলছেন তিনি।
জঙ্গিবাদ থেকে উত্তরণ
পনেরো বছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রায় ৪৮০% বেড়েছে উল্লেখ করে দ্য স্টেটসম্যান লিখেছে, “২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের দুর্বল রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার কারণে দূর্নীতি, সহিংসতা, ধর্মীয় চরমপন্থা এবং জঙ্গিবাদে জর্জরিত হয়ে পড়া দেশটির শাসনভার নেয়ার পরেও, শেখ হাসিনার সরকার পুরো পরিস্থিতি বদলে দেয় এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয় উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শান্তি, স্থিতিশীলতা, সম্প্রীতি এবং উন্নতির দিকে।”
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়ণশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের পথেও রয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তিন মেয়াদের উন্নয়নের উদাহরণ তুলে ধরতে গিয়ে আরটিভি অনলাইন গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লিখেছে, “সাবমেরিন কেবল (২০২০ সালে শুরু হয়েছে, শেষ হবে ২০২৪ সালে) থেকে শুরু করে ফ্লাইওভার, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে শুরু করে করে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রমাণ করে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের এই ১৪ বছরে উন্নয়নের চিত্র কতটা অর্থপূর্ণ ছিল।”
দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছাড়িয়ে গেছে পার্শ্ববর্তী বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত ও পাকিস্তানকেও।
ড. রাজ্জাক ‘হ্যাপি’
তবে সব উন্নয়নের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নকে সবচে এগিয়ে রাখতে চান বিশ্বব্যাংকের সাবেক জেষ্ঠ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
“আট নয় ঘণ্টা পর্যন্ত লোড শেডিং আমরা দেখেছি। সেই ধরণের পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতি বেরিয়ে এসেছে। বেশ একটা নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে”, বলছেন ড. হোসেন। অবশ্য আরো কম খরচে এটা করা যেত বলে মনে করেন তিনি।
পনেরো বছর ধরে বাংলাদেশের এই যে উন্নয়ন সেটা সন্তোষজনক বলে মনে করেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।
“আমরা হ্যাপি। আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সকল ক্ষেত্রেই হয়েছে”, বলছেন ড. রাজ্জাক।
ইশতেহার কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি এখন এখন কাজ করছেন আগামী পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ভোটারদের সামনে কী কী প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হবে তা নিয়ে।
এই ইশতেহারে কী থাকবে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার আগে জানাতে চাননি ড. রাজ্জাক। তবে জানালেন, মেট্রোরেলের আরো সম্প্রসারণ, ভূগর্ভস্থ রেল চলাচল ব্যবস্থা চালুর মত কিছু প্রতিশ্রুতি তাদের থাকবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
মুদ্রার অন্য পিঠে গত পনেরো বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বারবার উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, দূর্নীতির অভিযোগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে বিদেশে মুদ্রাপাচার সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ এবং দূর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে প্রকল্পের ব্যয় মাত্রাছাড়া হওয়ার অভিযোগ।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের এলিট বাহিনী র্যাব এবং তার কয়েকজন কর্মকর্তার উপর এসেছে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর প্রতিবছর বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০২২ সালে সেই প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে এসব অভিযোগের উল্লেখ আছে।
ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনগুলোর নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ঘাটতি নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন ওঠা এখন এই নির্বাচনের আগে এসেও থেমে নেই।
‘গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে’
গত ১১ ডিসেম্বর সাতটি বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠন এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এই সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, দ্য ইউনাইটেড এগেইনস্ট টর্চার কনসোর্টিয়াম, এশিয়ান ফেডারেশন এগেইন্সট ইনভলান্টারি ডিজএপিয়ারেন্স, এন্টি ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন এগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্স এবং দ্য এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলছেন, “গত পনেরো বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলে দুটো জিনিস আমরা লক্ষ্য করছি। একদিকে উন্নয়ন বা সামর্থ্যের বাইরের উন্নয়ন, আরেকদিকে আমরা দেখছি যে গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে। কথা বলার অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। মানুষের জীবনের যে অধিকার সেটাও অনেক ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হচ্ছে
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের চোখে, স্বাধীনতাবিহীন উন্নয়ন মানুষের জন্য খুব একটা অর্থ বহন করে না।
তিনি বলছেন, “আর্থসামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, মানবাধিকারগুলো আছে – এর মধ্যে, সাংবিধানিক অধিকারগুলো আছে – বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনাতা – এগুলো সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে, পদদলিত করে যে উন্নয়ন অর্থবহ হবে সেটাতো আশা করা খুব কঠিন। শুধু অর্থবহ না, এটা টেকসই হবে সেটাও আশা করাটা কঠিন”।
“এক ধরণের বাবলের মধ্যে হয়তো আমরা আছি”, বলছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
“যখনই যারাই রেফার করে বিশেষ করে যারা বিশেষজ্ঞ, তারা বলে যে হ্যাঁ এটা প্রবৃদ্ধির একটি উদাহরণ। কিন্তু তারাই আবার বলে যে বাংলাদেশ ইজ এ ডিলেমা (বাংলাদেশ একটা সংশয়)”।
“এটা সংশয়ের একটা উদাহরণ”
আ হ ম মুস্তফা কামালের স্বীকারোক্তি
বাংলাদেশে ২০২১-২০২২ সালের যে বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সেখানে তখন চলমান দশটি মেগা প্রকল্পের জন্য ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রেখেছিলেন তিনি।
ওই বছরের বাজেটের মোট বরাদ্দের তুলনায় এই বরাদ্দ ছিল ৯%।
কিন্তু এসব প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন আছে।
গত বছর নভেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনকে উদ্ধৃত করে দৈনিক যুগান্তর লিখেছিল, বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নির্মাণে যে খরচ করা হয়েছে তা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত।
অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজ টোয়েন্টি ফোরকে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মানের উচ্চ ব্যয়ের কথা স্বীকার করেছিলেন।
বাংলানিউজ টোয়েন্টি ফোরে প্রকাশিত ওই খবরের সাথে যে ছবি ছাপা হয়েছিল, তার ক্যাপশনে লেখা হয়েছিল, “বিশ্বের সবচাইতে ব্যয়বহুল উন্নয়ণের দেশ বাংলাদেশ”।
মুস্তফা কামাল সেখানে বলেছিলেন, “ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সড়ক ও রেলপথ তৈরির ক্ষেত্রে অন্য সবার চেয়ে বেশি টাকার প্রয়োজন হয়”।
কিন্তু অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ও টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান এই উচ্চ ব্যয়ের পেছনে সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতিকেও কারণ হিসেবে দেখেন।
ড. জাহিদ-এর ‘ভ্যালু ফর মানি’
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, যে কোন উন্নয়ন প্রকল্পের যখন ব্যয় উচ্চ হয়ে যায় তখন ‘ভ্যালু ফর মানি’ কমে যায়।
“যত টাকা আমরা বিনিয়োগ করেছি, অন্যান্য তুলনামূলক দেশ ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এখানে ৫০-৬০% উচ্চ ব্যয়ে মেগা প্রোজেক্টগুলো হচ্ছে”।
এটা কেন হচ্ছে?
ড. হোসেনের এক কথায় জবাব, “করাপশন”।
“আপনি বলতে পারেন না যে এটা অদক্ষতার কারণ। কারণ আমরা যাদের সাথে তুলনা করছি তাদের প্রশাসন যে আমাদের থেকে দক্ষ তার প্রমাণ কোন তথ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ওইসব দেশেও আছে। ওইসব দেশে দুর্নীতিও আছে।”