১৯৭১ সালের আগে ও পরে বাঙালিসহ বাংলাদেশের সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর জাতীয় শত্রু, পাকিস্তানের দোসর, পেয়ারের দোস্ত নরপিশাচ জামায়াতে ইসলামী। তাদের স্থির লক্ষ্য, উদ্দেশ্যে ইস্পাত, কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, এখনো আছে। সেটা বাংলাদেশের আমজনতা থেকে শিক্ষিত নামধারী সবাই কম-বেশি এই জাতশত্রুদের সম্পর্কে জানে। আজ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও পরাজিত শত্রুরা বাংলাদেশের পতাকা, জাতীয় সংগীত, বাংলাদেশের জনপদের অস্তিত্বের মূল বিষয় নিয়ে কঠিনভাবে খামচে ধরেছে।
৭১-এ তারা যা যা করেছে, আজ ৫৩ বছর পর আবারো রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী এবং বিএনপি’র যোগসাজগে করে যাচ্ছে। গত ৫ আগস্ট ২০২৪, কোটা নামধারী ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে আন্দোলনের মূল খেলোয়াড় ছিল জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির। এছাড়া আছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভেতরে জামায়াতের মতাদর্শী জিহাদি গোষ্ঠী। তাদের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে একটা গণঅভ্যুত্থান ঘটায় তারা। এই রাজনৈতিক নতুন পট-পরিবর্তনের বাস্তবতায় বাঙালি জাতি ও সব নৃ-গোষ্ঠীর অস্তিত্বের মূলে আঘাত দিতে দেশের সেনাবাহিনীর ভিতরে জামায়াত ও বিএনপির আদর্শের সৈনিক, বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের চৌকস ছাত্র নামধারীরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। তাদের নেতৃত্বে সব কুখ্যাত অপরাধী, ডাকাত, খুনি, জিহাদি জঙ্গী জেলখানা থেকে নিঃর্শতে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে বা ছেড়ে দিচ্ছে বাংলাকে শ্মশান বানানোর জন্য। তথাকথিত বাংলা ভাইয়ের খুনিসহ ইসলামের সব আফগান সৈনিকদের জেলখানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে তারা। যথারীতি স্ব-স্ব জায়গা থেকে এইসব অপরাধীরা গলা উঁচু করে হুংকার দিয়ে যাচ্ছে, ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগানিস্তান।’ তারেক জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে বলেছিলেন, ‘ছাত্র শিবির ও ছাত্রদল হলো একই মায়ের পেটের দুই সন্তান, ভাই-ভাই।’
বাংলার মাঠে ঘাটে এই অপশক্তিকে নামিয়ে দিয়েছে তথাকথিত অন্তর্বতী সরকারের প্রধান ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারের উপদেষ্টা কমিটি। তারা এখন মুক্ত ডানা মেলা পাখি। যা ইচ্ছে তাই করার হুকুম সেনাবাহিনীর সমর্থিত অন্তর্বতী সরকার ও সরকার প্রধান ইউনুস তাদের দিয়েছে। তাদের নেতৃত্বে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রকাশ্যে হিন্দু সংখ্যালঘু বলে, ফেইসবুক বা সোস্যাল মিডিয়ায় নিজেরাই ফেইক আইডি বানিয়ে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে দিয়ে খুন করছে, বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পুঁড়ে দিচ্ছে, মা-বোনদের বিবস্ত্র করে সম্মানহানি এবং নির্যাতন করছে। এ যেন ১৯৭১ সালের পুনরাবৃত্তি।
কৈশোর উত্তীর্ণ ১৬ বছরের যুবক উৎসব মণ্ডলকে জিহাদি সৈনিকরা হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে তার উপর তাণ্ডব চালায়। চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে। কেউ বলে, সে মারা গিয়েছে, কেউ বলে সে এখনও জীবিত আছে। দেশের আনাচকানাচে যত্রতত্র অলি-আওলিয়ার মাজার ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে জিহাদি গোষ্ঠীরা। আবুল আলা মওদুদীর ‘মওদুদীবাদ’ বা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের ‘ওয়াহিবিজমের’ দর্শন মানেই হলো ধর্মীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা। সেখানে অন্য কোনো ধর্মের নিশানা থাকবে না। ধর্মীয় বিশ্বাসের সংগঠন থাকবে না। মুক্তচিন্তা বা বাকস্বাধীনতা থাকবে না। ইসলাম ধর্মের ভেতর শিয়া, সুন্নি, আহমেদিয়া, কাদিয়ানী, আটরশি, মাইজভান্ডারির সঙ্গে মারামারি কাটাকাটি, খুনাখুনির অরাজকতা চলছে। দেশে এমন এক নারকীয় তাণ্ডব অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যা ১৯৭১ সালের নির্মম, নারকীয় হত্যাকাণ্ডগুলোর বাস্তবতা নিয়ে ফিরে এসেছে। জামায়াতের সংঘবদ্ধ দল ছাত্র-জনতাকে ব্যবহার করে ধেই ধেই করে বাংলাকে মরণ-ছোবল দিয়েছে আবারও। এসবের জন্য আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা সরকার সবচেয়ে বেশি দায়ী। কেন দায়ী? সেসব আমরা সবাই কম-বেশি জানি। তবে প্রধান দায়ী শেখ হাসিনা। একদিকে সে শেখ মজিবের মেয়ে, ছোটকাল থেকে রাজনীতির বলয় থেকে বড় হওয়া মানুষ। অন্যদিকে রাজনীতিতে পোঁড় খাওয়া অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ। এই শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের ঠিকাদারি এবং গণতন্ত্রের নামধারী গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে নিজের একচ্ছত্র গোয়ার্তুমি, অহংকার আর অজ্ঞতার কারণে। সবকিছু দেখেশুনে নিজের ক্ষমতা আমৃত্যু ধরে রাখার জন্য বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করা, গুম, জেল, জুলুম এবং বাকস্বাধীনতার করব রচনা করেছিল শেখ হাসিনা। তার হাতে গড়া চাটুকারদের দিয়ে আবদ্ধ হয়ে যত ধর্মীয় বিশ্বাসের সংগঠন আছে, ছিল, তাদের তাবেদারি করেছে ক্ষমতার পুরো সময়জুড়ে। বাংলাদেশে ৭২-এর সংবিধানের মূল চার নীতি দলিত করে নিজের মতো করে তা কাটছাট করে দেশের সংবিধানে বিসমিল্লাহ রেখে, ইসলাম ধর্মকে প্রধান করে সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আর খেয়াল খুশিমতো।
২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ ও সেই আন্দোলনকে কুক্ষিগত করে তা বিনাশ করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির সোনার ছেলেদের তার ক্ষমতায় থাকাকালে জিহাদি গোষ্ঠী হত্যা করেছিল। হত্যাকারীদের না ধরে, বিচারের প্রহসন করে বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রেখেছিল, রেখেছে। উল্টো, উস্কানিমূলক কথা বলে জিহাদিদের আরও অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। দেশ নাকি চলবে, মদিনা সনদ অনুযায়ী। কত বড় হিপোক্রেট! ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে এমন ঘোষণা করে সে কিভাবে? মুক্তিযুদ্ধকে নিজের বাপের সম্পত্তি মনে করে যা ইচ্ছে তাই করেছে সে।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ফসল যেন তার একক বাপ-দাদার সম্পত্তি এবং তার পার্টির একার ফল ছিল। এমন আচরণ ক্ষমতাকালে শেখ হাসিনা করেছিল। নিজের বাবা এবং শেখ হাসিনাই যেন বাংলাদেশের সবকিছুর মূল ছিল। অথচ আমরা জানি অন্য ইতিহাস। সেই ইতিহাসের অন্যতম মূল নায়ক ছিলেন তাজউদ্দীনসহ চার নেতৃত্ব, যাদের নেতৃত্বে একটা সফল জনযুদ্ধ হয়েছিল। সেই সফল জনগণতান্ত্রিক যুদ্ধের মূল স্তম্ভ ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র। অথচ পুরো বাঙালি জাতির জীবনের ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি হয়েছে, জনযুদ্ধের মূল স্তম্ভের ঠিক বিপরীত কাজ।
২০১৩ সালের শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কথা আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশের সব মানুষ জানে। সেই গণজাগরণ মঞ্চকে এই শেখ হাসিনার সরকার কিভাবে তার কবর রচনা করেছিল সেসবও জাতি জানে। সেখান থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এই শেখ হাসিনা এবং তার সরকার এক এক করে রাষ্ট্রের সবগুলো স্তম্ভের কাঠামো ধ্বংস করে। ৫৭ ধারা আইন করে মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করে। বাকস্বাধীনতা এবং কলমে লেখা কালির উপর বলৎকার করে। যারাই স্বাধীনভাবে কিছু বলতে বা লিখতে গেছে, তাদের ওই আইনের ধারায় জেল, জুলুম, হামলা, মামলা দিয়ে লেখা ও কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করে। কিভাবে নির্লজ্জের মতো হেফাজতে ইসলামীদের নিজের কোলে স্থান দিয়েছিল। যে হেফাজতিরা ৮৪ জন বাংলার সূর্য সন্তানদের নাম লিস্ট করে শেখ হাসিনার সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিল, যেন তাদের জেলে ভরে ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থা করে, ব্লাসমেসি আইনে তাদের বিচারের দাবি করে।
অন্যদিকে জিহাদি গোষ্ঠী, বাংলার সূর্য সন্তানদের হত্যা করার মিশনে নেমে তারা অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর রহমান বাবুসহ অনেক মুক্তমনাকে প্রকাশ্যে হত্যা করেছে। অনেক মুক্তমনা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ সেই কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। শেখ হাসিনা তাদের কথাই রক্ষা করেছে বারবার, প্রতিবার। হেফাজতের দিয়েই ধর্মরক্ষার ‘কওমি-জননী’ উপাধিতে ভূষিত হয় শেখ হাসিনা। অথচ এই হেফাজতরাই শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করতে গিয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ মে।
এভাবেই শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ধ্বংস করে নিজের ক্ষমতা ও নিজ আসন দখল করে নিজে একক স্বৈরাচারী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। তার পার্টির নেতা-নেত্রী থেকে পাতি নেতা, রাষ্টের সব প্রতিষ্ঠানের হোমরা-চোমরা, আমলা, সেনাবাহিনী, তথাকথিত কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি, বুদ্ধিজীরীরা শেখ হাসিনার নাম ভাঙিয়ে এমন কোনো হেন কাজ নেই, যা তারা করেনি। আসলে ক্ষমতায় গেলে যে, মানুষ আর মানুষ থাকে না, নিজেকে দেব-দেবীর আসনে সামিল করে, সেটাই বারবার আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের রাজনীতিতে। যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ।
আওয়ামী লীগ পার্টির নামে, ক্ষমতার নামে ক্ষমতাধারী রাঘব-বোয়ালরা বাংলার জনগণের রক্ত চুষে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে, ব্যাংকের মালিক হয়ে সেসব টাকা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। যেমন, কানাডার বেগম পাড়া। হাসিনার নেতৃত্বে সেনা, আমলা, বুদ্ধিজীবী থেকে নিজের ঘরের যে চাকর, সেও নাকি চারশ কোটি টাকার মালিক হয়েছিল। শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে রসিকতা করে এই চাকরের কথা নির্লজ্জভাবে মিডিয়ায় বলেছিল। কি ভয়ানক অবস্থা! দেশের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যা তার আমলে ধ্বংস না করে ছাড়েনি।
সবচেয়ে বেশি ধ্বংস করেছে আইনবিভাগ ও আইনের শাসন। এরপর পুরো শিক্ষাব্যবস্থার। শিক্ষাব্যবস্থার মান নিয়ে গেছে মাদ্রাসা শিক্ষার সমান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন এখন হিজাব পরা ইরান, আফগানিস্তান বা সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয়। সবকিছু নিজের বাগে নিয়ে শেখ হাসিনা মনে করেছিল, সে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন বা চায়নার শি জিনপিং হবে। সেই আশার আখেরে হয়েছে গুড়েবালি।
তৃতীয় বিশ্বের এসব নেতা-নেত্রী রাজনীতির ইতিহাস বলে যে কিছু আছে, জনগণের ক্ষমতা বলে যে কিছু আছে, সেটা তারা একবার ক্ষমতায় গেলে পরে আর ঘুণাক্ষরেও তা মনে রাখে না; রাখার দরকার মনে করে না। দেশের জনগণের অধিকারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ক্ষমতাশীলরা মনে করে, আমৃত্যু তাদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে হবে। সেই জায়গা থেকে সব দল, মত নির্বিশেষে জনগণের ন্যয্য মৌলিক দাবি-দাওয়া এবং বিরোধী দলের রাজনীতি ধ্বংসই যেন সেসব স্বৈরাচারী সরকারের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। শেষত যার মাশুল যেমন তাদের দিতে হয়, তার থেকে কোটি গুণ বেশি দাম দিতে হয় সেই দেশের আপামর জণগণকে।
এইরকম পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। কোন পথে যাবে তার দিশা, পরিচয়পত্র কিছুই তারা খুঁজে বা বুঝে পায় না। গরীব আরও গরীব হয়ে যায়। সমাজে প্রবলভাবে আরো বেশি শ্রেণিবৈষম্য তৈরি হয়। অশিক্ষায়, কুশিক্ষায় ডুবে যায় সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহৎ অংশ। মানুষ তখন অদৃষ্টের উপর ভীষণ ভর করে। ঘরহারা হয়। জীবন ক্ষয়ে যায় খুব দ্রুতই। আধ্যাত্মিকতায় ডুবে যায় মানুষের জীবন। মানুষ তখন তার জীবনের পরম শান্তি খোঁজে। মরে গেলে বেহেশতে যাবে, এমন বাণী ধর্মীয় সংগঠনের সহায়তায় তাদের ব্রেইন ওয়াশ করা হয় রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে।
রাষ্ট্রের সব ক্ষমতাশীলরা সব তন্ত্রের নামে সমাজের সেই বড় অংশকে সবসময় তাদের জীবনকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আহরণ করে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে কেউ আর সমাজের সেই বড় অংশের জীবনের মৌলিক অধিকারের দাম দেয় না। জীবনের মৌলিক অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে বারবার, শতবার, হাজারবার। বেঁচে থাকার তাগিদে বঞ্চিত মানুষ তখন ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেয়। রাস্তাঘাটে, সমাজের আনাচকানাচে, এখানে-সেখানে তারা ভাসমান শেওলার মতো ভাসে রাষ্ট্রের চারিদিকে। সমাজের উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা সেই ভাসমান মানুষদের প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা আর অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। দেখে, এই গরীব অবহেলিত মানুষ যেন পশু শ্রেণির থেকেও অধম। অথচ এই অধমদের ব্যবহার করেই তারা ক্ষমতায় যায়। ক্ষমতায় যারা যায়, তারা ওই অধমদের ভুলে গিয়ে দেশের উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের স্বার্থরক্ষাই যেন একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সেই ক্ষমতার পেছনে বড় নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে এই উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
ক্ষমতাশালীরা অথবা নতুন করে যারা ক্ষমতা পায় বা নেয় তারা ক্ষমতায় এসেই সেই দোদুল্যমান মধ্যবিত্ত, ভাসমান এবং গরীব মেহনতি মানুষের জীবন নিয়ে রক্তের হোলি খেলা খেলে আবারও। ঘৃণা আর হিংসার বাণী সমাজের মানুষের মাঝে আরও তিন গুণ বেশি ছড়িয়ে দেয়। নতুন করে রাজনীতির ক্ষমতায় এসে তাদের ক্ষমতা আবারও কুক্ষিগত করে নেয়। রাজা যায়, রাজা আসে। ক্ষমতার পালাবদল হয় বারবার। জনজীবন যেখানে ছিল সেখান থেকে আরও নিচে নেমে যায়। ক্ষমতায় এসে নতুন রাজা-রানি আবারও আগের স্বৈরাচারের পথ ধরে। ক্ষমতায় এসেই আগের সরকার, যারা তাদের উপর নিপীড়ন ও অত্যাচার করেছিল, সেই একই কাজগুলো তারা ক্ষমতা পেয়েই আগের সরকারের মতাদর্শের মানুষের উপর শুরু করে দেয়।
অন্যদিকে আমজনতার জীবন যেখানে ছিল সেখান থেকে নিচে নামতে নামতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ তখন যা ইচ্ছে তাই করে। সমাজ ও রাষ্ট্রে ভীষণ অস্থিরতা তৈরি হয়। চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি খুব বেড়ে যায়। মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক মনোজগৎ কুশিক্ষায় এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের প্রভাবের সঙ্গে আবারও ষোল গুণ বেশি রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, হতাশা বেড়ে উঠে সমাজের মানুষের মন ও মননে। সেটার প্রতিক্রিয়া পড়ে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের ওপর। এই আবর্তে যেন তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি চলমান থাকে। এটাই যেন তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায় যুগে যুগে, শত সহস্র বছর ধরে।
জামায়াতে ইসলাম তার লক্ষ্যে সফল হওয়ার জন্য অনেক ফন্দি আঁটে গত ১৬ বছর। অবশ্য সেই ফন্দি, ছলচাতুরি তাদের পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই করে আসছে। তারা আওয়ামী লীগের পার্টির ভেতরে প্রথম সারির নেতা -নেত্রী থেকে হোমরা-চোমরা নেতাদের টাকা পয়সা দিয়ে বাগিয়ে নেয় দলের পদ-পদবি। গ্রাম থেকে শুরু করে শহর, বন্দরজুড়ে জামায়াতের বাহিনী আওয়ামী লীগের ভিতরে ঢুকে কাজ করে। যেটা একসময় বাংলাদেশের সিপিবি করেছিল বাকশালে যোগ দিয়ে। সিপিবি তাদের লক্ষে সফল হয়নি। কিন্তু জামায়াতে ইসলাম দেখতে পাচ্ছি সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য সফলতা কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটা বলা দুরূহ ব্যাপার। বাংলাদেশের রাজনীতির ৫৩ বছরের ক্ষমতায় যারাই ছিল, তারাই জামায়াতের তোষামোদ করেছে। এটা কিভাবে সম্ভব হলো মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে? সর্ষের ভেতর ভূত।
শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা থেকে শুরু করে জামায়াত রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আসীন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। সেসবের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গত ৫০ বছরে জামায়াতে ইসলাম ফুলে ফেঁপে ওঠে এক অজগর সাপে পরিণত হয়েছে। বিএনপির লেজ ধরে তারা সেইসময় প্রতি বছরে নাকি দুই হাজার কোটি টাকা আয় করতো। বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত সেইসময় ডাটাবেজ আকারে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতিকে তা জানিয়েছিল। যদিও এইসব পার্টি জামায়াতের ভিতরে জামায়াত, জামায়াতের এপিঠ আর ওপিঠ। জামায়াতে ইসলাম যেন অন্যসব পার্টির তৈরি করা এক জলন্ত ফ্রাংকেনস্টাইন।
যুদ্ধাপরাধীর সূত্র ধরেই রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি যে, জামায়াতে ইসলামী পার্টিকে নিষিদ্ধ করার। এর জন্য উপত্তি হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের গণ-আদালত মঞ্চ এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সেই গণ-আন্দোলন যখন সফল সমাপ্তির ধারপ্রান্তে এসে যায়, তখনই ঘটে যায় বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এক কালোরাত্রির। আন্দোলনের প্রজ্ঞাবান নেত্রী জাহানারা ইমাম গলার ক্যান্সারে মারা যান। আন্দোলন আবারও ছিটকে পড়ে। আর তাতে জামায়াতের কপালে মধুচন্দ্রিমার ফুল ফুঁটে ওঠে। জাতি আবারও গভীর অন্ধকার খাঁদে পড়ে যায়। হাবুডুবু খেতে থাকে উথালপাতাল জোয়ারের নদীতে। এর কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না বাঙালি জাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সবাই। আমাদের বাংলাদেশের মানুষের জীবনের যে মূল অস্তিত্ব তার দিশা, পরিচয়পত্র যেন হারিয়ে ফেলছে। দেশের রাজনীতির সবকিছু এমন জগাখিচুড়ি আর লেজেগোবরে করে ফেলেছে, কোনটা যে ঠিক আর কোনটা বেঠিক, সেটাই নির্ধারণ করতে পারছে না বাংলাদেশিরা। যেই ক্ষমতায় আসীন হয়, প্রথমেই বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে আঘাত করে। অথবা অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। এখানে এসেই সবাই স্থবির হয়ে যায়। গাছের গোঁড়া কেটে দিয়ে সবাই কম-বেশি গাছের ডালপালা নিয়ে মেতে আছে। শিক্ষিত বুদ্ধিমান এবং বুদ্ধিজীবী থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতির লোকজন শুধু বকোয়াজগিরি করে যাচ্ছে, কে কত সঠিক আর কে কত বেঠিক। সেই দিশাহারা শূন্যতায় বিরাজ করছে জামায়াতে ইসলামীসহ সব ইসলামি দল। তাদের শক্তিকে আরও বেশি শক্তিশালী করেছে আওয়ামী লীগসহ সব ঘরানার রাজনৈতিক পার্টি। এই দায়ের সঙ্গে আরও দেখতে পাই যে, ওইসব পার্টির ভেতরের বুদ্ধিবৃত্তিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষজন এবং বাম-ঘরনার চিন্তাবিদদের। সঙ্গে আছে বাম-ঘরনার রাজনৈতিক পার্টিগুলোর দেউলিয়াপনা। বাম পার্টিগুলো তাদের অস্তিত্বের দিশা যেন আর খুঁজে পায় না। তাদের নিয়তিই হচ্ছে যে, ডান ও দক্ষিণপন্থি পার্টিগুলোর লেজ ধরে নিজেদের খায়েশ চরিতার্থ করার। আর রাস্তা-ঘাটে, মাঠে-ঘাটের সভায় বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের চোদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে। রাশিয়া আর চায়নার পদলেহন করে। এসব দেউলিয়াপনার আড়ালে সবাইকে লেবেনচোষ চুষতে দিয়ে বাংলাদেশের জাতশত্রু জামায়াতে ইসলাম এবং বিএনপি তাদের সব এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাস্টারপ্ল্যান করে। সেই প্ল্যানের ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই যে, এবারের ২০২৪-এর সংসদ নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ না করা। তলে তলে যে কী পরিমাণ বড় খেলা হচ্ছে, সেটার আঁচ আজীবন ক্ষমতালোভী পার্টি আওয়ামী লীগ এবং তার সোকল্ড ১৪ দল বুঝতে পারেনি। এমন ভাবনা তাদের ছিল যে, হাসিনার পরে আওয়ামী লীগের কে প্রধান হয়ে আসবে, সেসব নিয়ে আলোচনা আর চিন্তা ভাবনা। এমনই দলকানা আর ক্ষমতালোভী তারা। ধরাকে তারা সরা মনে করে, এমন বিভীষিকাময় রাজত্ব কায়েম করেছিল গত ১৬ বছর ধরে।
এ রাজত্বের বিভীষিকাকে কাজে লাগিয়ে আর মানুষের নেতিবাচক মনোভাব, হিংসা আর ঘৃণাকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাজনীতির জাতশত্রু জামায়াত-বিএনপি ৫ জুন ২০২৪-এ কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে ছাত্রদের রাজপথে নামিয়ে নিয়ে আসে। যদিও এর ধারাবাহিকতা শুরু হয় ২০১৮ সালে। তা সম্পন্ন করে এবার ২০২৪ সালে আগস্টের ৫ তারিখ। ছাত্রজনতাকে সামনে রেখে পেছনে প্রতিক্রিয়াশীল সেনাবাহিনীর জিহাদি গোষ্ঠীরা দাবার চাল খেলে যায়। খেলায় সাময়িক জিতে তারা। তাদের হাতে ছায়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেয়। এখন জামায়াত পুরো দেশের ক্ষমতা নেওয়ার জন্য জোরেশোরে মাঠে নেমেছে। এবার খেলা হবে যারা তাদের প্রধান মিত্রবাহিনী ছিল, বিএনপির সঙ্গে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি যাদের দুধ-কলা খাইয়ে বড় দানব বানিয়েছিল, তাদেরই এখন জামায়াতে ইসলামী এবার বড় ছোবল মারার জন্য তেড়ে আসছে বা আসবে। প্রথমে যারা আওয়ামী লীগের কর্মী, নেতানেত্রী আছে, তাদের জেল, জুলুম, অত্যাচার করছে, করবে। এরপরে প্রগতিশীল, বাম, মুক্তচিন্তা ও ব্লগারকে আবারো হত্যা করার মিশনে নামবে। তার সাথে তো ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে ব্যক্তিগত হিংসা, দ্বেষ রোষের আগুন লেগেই আছে, থাকবে।
খেলা তো মাত্র শুরু হয়েছে। দেশে অসংখ্য কুৎসিত জঞ্জাল তৈরি করা হয়েছে, এর যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। একদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশের ভেতরে বড় আকারের সমস্যা লাগানো আছে, যে সমস্যা বাঙালিদের জীবনে বহুকাল ধরে বহমান থাকবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর প্রতিনিয়ত জুলুম, অত্যাচার, খুন, জবরদস্তি, উচ্ছেদ করে সম্পত্তি দখল করা এবং আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উপর বাঙালি নামের ক্ষমতা ও টাকাওয়ালা মানুষেরা জবরদস্তি করে তাদের উচ্ছেদ ও সর্বনাশ করছে এবং এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উপর সমতলের বাঙালি এবং সেনাবাহিনীর অনাচার, অত্যাচার খুব করে চলমান আছে গত ৫০ বছর থেকে। আসামের সঙ্গে পূর্ব অঞ্চলের উলফাসহ যত সমস্যা আছে, সেগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বা উঠানো হবে।
মনিপুরী, খ্রিষ্টান, হিন্দু, মুসলমান, মুসলমান ধর্মের ভেতর শিয়া, সূন্নি, আহমদিয়া, কাদিয়ানি, কে কোন ধর্মের, তা নিয়ে খুব করে মানুষে মানুষে আরো বেশি করে সংঘাত বেঁধে উঠবে। অন্যদিকে আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের মতো ড. ইউনুস নামের এক ভাঁড়, বৃদ্ধলোককে উড়ে নিয়ে এসে সামনের চেয়ারে বসিয়ে রাতের অন্ধকারে গভীর প্রেমের খেলা চলছে দেশীয় কালোবাজারি, চোরাকারবারি, মাফিয়া রাজনৈতিক ব্যবসায়ী ও সেনাবাহিনীর জিহাদি চক্রের সঙ্গে। এই খেলার নিয়ামক শক্তি তাহলে কে? সেটা আমরা জানি, বুঝি বা দেখতে পাচ্ছি। দেশীয় সেই নাটেরগুরু তাত্ত্বিক নেতা ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান, আসিফ নজরুল গংরাসহ তাদের সমমনা সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবী নামের অনেকেই। সঙ্গে বৈষম্য মোচন নামের জামায়াতের নব্যজিহাদি ছাত্র নামধারী সৈনিকদের, যারা আসলে ছাত্র শিবিরের চৌকস বাহিনী। সঙ্গে হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহিরিসহ অন্য ইসলাম ধর্মের ভেতর পেটোয়া বাহিনী। পেছনে বসে মূল কাণ্ডারি হয়ে বসে আছে সেনাবাহিনীর জঙ্গী জিহাদি গোষ্ঠী, যারা আসলেই সব নাটেরগুরু। তাদের নাটের গুরু কে? তারা হলো আমেরিকা চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাশালী আন্তর্জাতিক শক্তি। কী চায় তারা? তারা চায়, বাংলাদেশ যেন কোনো দিন একটা গণতান্ত্রিক বা সেক্যুলার রাষ্ট্র না হতে পারে। সেখানে ধর্মের নামে ধর্মীয় পার্টি দিয়ে আমাদের মাঝে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রাখা, আস্তিক-নাস্তিক নামের বায়বীয় অনুভূতির জন্ম দিয়ে মানুষের মাঝে চির ধুরন্ধর দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখা। মানুষের সঙ্গে মানুষের জাতপাতের নামে হিংসা-বিদ্বেষ লাগিয়ে রাখা। বাঙালি জাতির যে অস্তিত্ব ‘মুক্তিযুদ্ধ’, সেটার অস্তিত্ব মুছে ফেলা। প্রতিক্রিয়াশীলদের দিয়ে সব সময়েই তারা সেই জায়গায় প্রথম আঘাতটা করে। মুছে ফেলতে চায় বাঙালির শেকড় এবং বাংলাদেশের মূল অস্তিত্ব। তা না হলে তাদের যেসব এজেন্ডা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর এবং ভূপ্রকৃতির যে রাজনৈতিক বলয় আছে, সেগুলোর আশা পূর্ণ হবে না। যে খেলা তারা খেলছে বহু বহু বছর, যুগের পর যুগ ধরে। সে খেলায় এখন মত্ত আছে আসলে প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা বনাম চায়না, মাঝখানে ইন্ডিয়া। সে ত্রিমুখী যুদ্ধের বলি হচ্ছে বাংলাদেশ। সে খেলার মূল বিষয়ই হলো ক্ষমতা আর ক্ষমতা, যার নাম আন্তর্জাতিক ক্ষমতা। ক্ষমতার নামে তাদের স্বার্থ রক্ষা করা। তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখা। সঙ্গে অস্ত্রের আমদানি তো আছে, ছিলই। তাদের অস্ত্র-বিক্রির ব্যবস্থা করা, যুদ্ধবহরের ঘাঁটি করা আমাদের বঙ্গোপসাগরে। তাদের ক্ষমতা, লোভ, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিবাদের কারণে আমরা মাঝখানে পড়ে আমাদের জীবন নিয়ে তারা ছিনিমিনি খেলছে প্রতিনিয়ত। আমাদের জীবন আমরা বলি দিচ্ছি তাদের ক্ষমতার রোষানলে পড়ে। এটা আমরা জেনে-বুঝেও বুঝতে পারছি না।
তার আগে তারা দেশীয় কালোবাজারি মাফিয়া ব্যবসায়িক রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে দেশে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভাজন তৈরি করেছে খুবই ঠান্ডা মাথায়, মারাত্মকভাবে। স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ তৈরি করে মানুষের মাঝে মারাত্মক হিংসা আর ঘৃণার বাণী ছড়িয়েছে। গত ৫০ বছর খুব ঠান্ডা মাথায় তিলতিল করে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির মাধ্যমে জনগণের মাথা ওয়াশ করেছে। ধর্মের নামে ওয়াজ মাহফিলে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে, বছরের পর বছর ধরে গ্রামের সরলপ্রাণ মানুষের আবেগকে পুঁজি করে ব্রেইন ওয়াশ করেছে। আমদের অস্তিত্বের পরিচয় মুছে দিয়ে বানানো হয়েছে, আমরা মুসলমান।
কে বাঙালি আর কে বাংলাদেশি, গত ৫০ বছর ধরে এ নিয়ে মাফিয়া ব্যবসায়ী রাজনৈতিক পার্টিগুলো থেকে শুরু করে বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্য, সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রবল স্রোত বয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যখন যে ক্ষমতায় গেছে, তা তাদের মনমতো করে ধ্বংস করেছে। অন্যদিকে শুধু হাজার হাজার, লাখ লাখ মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন করেছে, করেছিল। জীবন ও জগতের সঙ্গে আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে কোনো মিল না রেখে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে গেছে মধ্যযুগীয় শিক্ষা ব্যবস্থায়। আইন বিভাগের কোনো আমূল পরিবর্তন না করে ব্রিটিশদের করা আইন দেশে বলবৎ রেখেছে। যে যখন ক্ষমতায় গেছে, শুধু নিজেদের স্বার্থে যতটুকু দরকার ছিল, ততটুকুই পরিবর্তন করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বাজার খুলে দিয়ে বাংলার গরীব অবহেলিত জনগণ সেখানে গিয়ে আরবের সংস্কৃতি বাংলায় এনেছে। মানুষ বাঁচতে চায়। বাঁচার তাগিদে, ভালো জীবনের সন্ধানে মানুষ বের হবেই। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইউরোপ, আমেরিকায় গিয়ে আরও বেশি ধার্মিক হয়েছে, শরিয়া আইন প্রথার চালু করতে হিমশিম খাচ্ছে। নিজেরা সেসব দেশে গিয়ে শেকড়ের সন্ধানে না ঘরকা, না ঘাটকা হয়েছে। তার পরিচয় কী, সেটা সে নিজেই জানে না। এই সংকটে পতিত হয়ে তাদের জন্ম নেওয়া সন্তানেরা বেড়ে উঠছে এক বিভ্রান্ত প্রজন্মে, যা নিয়ে বাংলাদেশি বাঙালিদের মাঝে পারিবারিক দ্বন্দ্ব চরম আকারে বিরাজ করছে।
অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের যেসব দেশে বাংলাদেশি বাঙালি বসবাস করছে সেই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তার আত্মসংকট, ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক আচার-বিশ্বাসের কারণে মিশতে পারে না। পারে না বলে আত্মসংকটের কারণে তখন তাকে ধর্মের কাছে নতি স্বীকার করা ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না। সঙ্গে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রবাহ তো আছেই, যার দ্বারা আমরা প্রলুব্ধ হই। তাদের জন্ম দেওয়া প্রজন্ম বেড়ে ওঠে এক ট্রমাটিক আত্মপরিচয় নিয়ে।
ধর্মের বড়ি খাইয়ে হিন্দু, মুসলিম, আস্তিক-নাস্তিক এবং ১৪ রকমের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক দল। অর্থনীতি ধ্বংস করে মানুষকে আরও বেশি গরীব, অবহেলিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। সেখানে ৩২ রকমের মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন করেছে। তার জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে এসে বিনিয়োগ করেছে নামে বেনামে জামায়াত ও অন্য ধর্মীয় সংগঠনের মাধ্যমে। সেগুলো বিনিয়োগ করেছে যত্রতত্র, গ্রামেগঞ্জে, শহর-বন্দরের আনাচকানাচে, অলিগলিতে মাদ্রাসা, ধর্মীয় স্কুল, কলেজ, শরিয়া ব্যাংক, আরব ব্যাংক, হালাল ব্যাংক, সেবা প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষমতার তাহলে ভবিষ্যৎ কী? বাংলাদেশ একটা ভীষণ অন্ধকার নিকষ কালো গুহায় পড়ে গেছে। সেখান থেকে উঠে আসা আপাতত আর বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। নিজেদের মাঝে নিজেরা ধর্মে-ধর্মে, বর্ণে-বর্ণে খুব করে কাড়াকাড়ি, খুনোখুনি, মারামারি আত্মহুতির খেলা খেলে যাবে। সেটার প্রভাব পড়বে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের মাঝে। নিজের ঘর থেকে শুরু করে সমাজের সব কাঠামোর মাঝে। সেসব মারাত্মক হিংসা আর ঘৃণার বাণী চলবে বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবীদের মাঝে, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনের সব আঁতেল মানুষের মাঝে। এই খেলা চলতে চলতে হয়তো হঠাৎ করেই একদিন ফিনিক্স পাখির মতো সত্যিকারের জনগণতান্ত্রিক কোনো নেতা-নেত্রী উঠে আসবে হয়তো এই বাংলায়। অথবা বলা চলে, আসা লাগে নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদেই। বাংলার জনপদের মানুষের সত্যিকারের ইতিহাস ধারণকারী জনগণতান্ত্রিক সেই নেতা-নেত্রী উঠে এসে শকুনের হাত থেকে বাংলার জনপদের মানুষের মুক্তির ত্রাণকর্তা হবে। যেমন, এসেছিল ইউরোপের রেনেসাঁসের ভিতর দিয়ে শত শত বছর পরে ষোল শতকের রেষ ধরে আঠারো, উনিশ শতকে। এই যুগ তো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগ। ইনফো এবং বায়ো-টেকনোলজির যুগ। সেজন্য হয়তো শত শত বছর লাগবে না আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে। শেষমেশ বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষই মানুষের জীবন কোথায় যাবে তা নির্ধারিত হয়। এছাড়া যে অন্য আর কোনো পথ মানুষের জীবনে খোলা নেই। সেখানে যেতেই হয়, বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক। অথবা তা আমরা ধারণ করি বা না করি। এবার যে বা যারা এটাকে ধারণ করবে, তারাই সেটাকে পুঁজি করে সামনে যাবে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে। সে খেলায় কে মরবে বা বাঁচবে সেটা বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির বিষয় নয়। সব শেষে একটি কথা বলে যেতে চাই, ভালো থেকো আমার, আমাদের দুখিনী বাংলার জনপদের জনমানুষ।